মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:০৬ অপরাহ্ন
জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে একুশে পদক প্রাপ্ত লোকসংগীত শিল্পী সুষমা দাশ। পরিবারের পক্ষ থেকে দেশবাসীর কাছে দোয়া ও প্রার্থনা কামনা করা হয়েছে।
বর্ণাট্য জীবনের অধিকারী সুষমা দাশ একসাথে গান করেছেন বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম, বাউল দুর্বিন শাহ, বাউল আলী হোসেন সরকার, বাউল কামাল পাশা সহ বাংলাদেশের প্রমূখ প্রবীণ শিল্পীদের সাথে। বর্তমানে তিনিই সেই সারির শিল্পীদের মধ্যে সর্বশেষ জীবিত শিল্পী কিন্তু আজ সেই প্রদীপ নিভু নিভু হয়ে জ্বলছে। হঠাৎ নিভে যাবে সেই প্রদীপ।
হাজারো লোকগানের চাক্ষুষ সাক্ষী সুষমা দাশ সারাজীবন সাধনা করেছেন সংগীতের। লোকগবেষকদের কাছে প্রাচীন লোকগানের মূলবানী ও সুরের ধারক-বাহক হিসেবে তিনিই ছিলেন শেষ আশ্রয়স্থল। জীবনের সন্ধিক্ষণে এসে প্রবীণ এই শিল্পীর শেষ সময় যেনো শান্তির হয় এই প্রার্থনা করছি। সুষমা দাশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যাবে লোকসংগীতের শত বছরের ইতিহাস।
সংক্ষিপ্ত জীবনী-
বাংলা লোকগানের জীবন্ত কিংবদন্তি, বাংলার অন্যতম প্রধান শিল্পী, প্রাচীন লোকগানের চাক্ষুস স্বাক্ষী, সুললিত কন্ঠের অধিকারী একুশে পদকপ্রাপ্ত শ্রীমতি সুষমা দাশ ১৩৩৬ বাংলা মোতাবেক ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দে সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার শাল্লা থানার পুটকা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
সুদীর্ঘ সাত দশকের উর্ধ্ব সময় ধরে যিনি কন্ঠে স্বরস্বতিকে ধারণ করে আছেন সেই মহিয়সীর পিতা ছিলেন প্রখ্যাত লোককবি রশিকলাল দাশ এবং মাতা লোককবি দিব্যময়ী দাশ।
পিতামাতা উভয়ই গান রচনা করতেন এবং গাইতেন। তবে মাতা দিব্যময়ী দাশ কখনো বাইরে গান করেন নি কারণ সমাজ এটাকে বাঁকা চোখে দেখতো। তাই মেয়েলি পরিবেশেই তাঁর গান গাওয়ার সীমানা যেনো সমাজ নির্ধারিত।
স্বপ্নকে চাপা দিয়ে নারীদের জীবন যখন চলমান সেই কঠিন মুহূর্তে সুষমা দাশ এর ব্যাতিক্রম।
বয়স সবে মাত্র সাত।
ধামাইল গান তখন রপ্ত করে ফেলেছেন।
বাবার কাছ থেকে কবিগানের লতিও শিখে গেছেন।
একদিন মঞ্চে উঠে গান ধরলেন, পাশে বাবা বসা।
উপস্থিত সবার মধ্যে শোরগোল শুরু হয়ে গেছে।
কিন্তু বাবা রশিকলাল দাশ বললেন মা চালিয়ে যাও।
টান দিলেন কবিগানে।
সুরের মোহনায় কিছুক্ষণের জন্য মানুষের মধ্য থেকে সেই রক্ষণশীল ভাব উধাও হয়ে গেলো।
পরিবেশ স্তব্ধ।সবাই গানে মুগ্ধ।
গান শেষে আবার রক্ষণশীলতার প্রেতাত্মা ভর করলো উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে।
সেই সময় দাঁড়িয়ে গেলেন লোককবি রশিকলাল দাশ।
উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন সুষমা কেবল আমার মেয়ে নয় সে আমার ছেলেও।
উপস্থিত সবার মুখ বন্ধ কিন্তু সারা এলাকায় ঘটনাটি রটে গেলো।
সুষমা দাশের দাদী ঘটনা শুনার পর ছেলে রশিকলাল দাশকে খুব বকাবকি করলেন এবং সুষমা দাশকে ঘরে ঢুকতে মানা করলেন। মাতা দিব্যময়ী দাশের ক্ষমতা ছিলো না শাশুড়ির কথার প্রতিবাদ বা রোধ করার তাই কাঁন্না করলেন কিন্তু এইক্ষেত্রেও পিতা রশিকলাল দাশ বললেন আমি আমার মেয়েকে বাইরে গান করার অনুমতি দিলাম।
সমাজ কি বললো,লোকে কি বললো সেটা আমি কানে নেই না।
সুষমা গান করবে।
এইভাবেই পিতার প্রেরণা ও সমর্থনে সুষমা হয়ে উঠেন এক কিংবদন্তিতে।
সুষমা দাশই সিলেটের প্রথম মহিলা কন্ঠ শিল্পী যিনি ঘরের বাহির হয়ে মঞ্চে উঠে গান করেছেন যখন সমাজে নারীদের ঘরের বাহিরে জোরে কথা বলাকেও অন্যায় মনে করা হতো।
ছয় ভাইবোনের মধ্যে সুষমা দাশ ছিলেন সবার বড়ো।
তাঁর ছোটো ভাই একুশে পদকপ্রাপ্ত পণ্ডিত রামকানাই দাশ ছিলেন উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীতের ক্ষণজন্মা এক মহাপুরুষ।
ছোটো ভাই মহাপুরুষ দাশ ছিলেন বিখ্যাত বংশিবাদক আর আরেক ছোট ভাই গৌরাঙ্গ চন্দ্র দেশী মুক্তিবাহিণীর কমান্ডার।
গান সংগ্রহ :
লোকসংগীত গবেষকদের কাছে সুষমা দাশ এক চলন্ত লাইব্রেরী। প্রায় ২ হাজারের অধিক লোকগান মুখস্থ সুষমা দাশের।
কোন বই বা পান্ডুলিপির সাহায্য ছাড়াই তিনি মূল বাণীতে গান পরিবেশন করে তাকেন।সব গান তাঁর মনের খাতায় লিপিবদ্ধ।
রাধারমণ দত্তের গানের মূলবাণীর ধারক ও লোকগানের নির্ভুল ব্যাখ্যার জন্য সুষমা দাশ লোকগবেষকদের কাছে এক জীবন্ত ইতিহাস খ্যাত।
পল্লীগান,কবিগান,লোকগান,হোরিগান,ঘাটুগান,ধামাইল,সূর্যব্রত,পালাগান,কীর্তন,মনসা,গোষ্ঠলীলা,সুবল মিলন,বাউলা,ভাটিয়ালী,পীর মুর্শিদি এক কথায় লোকসংগীতের সব ধারার গানে তাঁর অবাধ বিচরণ।
তিনি যাদের সঙ্গে গান করেছেন তাঁরা প্রত্যক্যেই ছিলেন লোকগানের একেক বিষ্ময়।
যেমন হরিচরণ দাশ,মধুসূদন দাশ,কামাল পাশা,দুর্বিন শাহ,শাহ আবদুল করিম,রামজয় সরকার,আলী হোসেন সরকার,চন্দ্রাবতী রায় বর্মন প্রমূখ।
সবাই চলে গেছেন আর কালের স্বাক্ষী হিসেবে রয়ে গেছেন আমাদের প্রিয় শ্রীমতি সুষমা দাশ।
বিবাহ:
১৩৫২ বাংলা মোতাবেক ১৯৪৫ সালে সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা থানার চাকুয়া গ্রামের প্রাণনাথ দাশের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সুষমা দাশ।
তিনি চার ছেলে ও দুই মেয়ের জননী।
বেতারে যোগদান:
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ বেতার সিলেটের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে যোগদান করেন সুষমা দাশ।
গ্রাম থেকে প্রায় ৮ মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে তৎকালীন সময়ের মুড়ির টিন নামক যানবাহনে করে সিলেট আসতেন আবার গান শেষ করে বাড়ি ফিরে যেতেন।
এমনও হতো বাড়ি ফিরতে ফিরতে গভীর রাত।
সেই সময় মাত্র ৫২ টাকা সম্মানী পেতেন সুষমা দাশ।
পুরুস্কার :
সংগীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সুষমা দাশ বহু পুরুস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
তাঁর জীবনের গানের প্রথম পুরুস্কার পান
১৩৪৫ বাংলা বয়স তখন দশ।তৎকালীন সময়ে গ্রামের সবচাইতে বড়ো গৃহস্থ বাড়ীগুলোতে বিশাল কীর্তন গানের ব্যাবস্থা করা হতো।সারা গায়ের লোক উপস্থিত হতো কীর্তন শোনার জন্য।
সেই দিন যেই বাড়িতে কীর্তন সেই বাড়ীর মেয়ের জামাই এ্যাডভোকেট শুকলাল বাবু উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।
যখন পাঠশালা পাশকে অনেক বড়ো কিছু ধরা হতো তখন তিনি এ্যাডভোকেট।
সুষমা দাশ সেই কীর্তনের অনুষ্ঠানে ৬ টি গান করলেন।
শুকলাল বাবু তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে পুরুস্কার হিসেবে তাকে নগদ ৫০০ টাকা সম্মানী দেন।
দশ বছরের সুষমা দাশ সম্মানী পেয়ে এতোটাই খুশি হন যে, যেনো আকাশের চাঁদ হাতে ধরেছেন।
এটাই ছিলো তাঁর জীবনের প্রথম পুরস্কার।
এরপর পাকিস্তান আমলে স্থানীয় ইউএনও একটি অনুষ্টানে সুষমা দাশের গানে মুগ্ধ হয়ে জানতে চান আপনাকে কি পুরুস্কার