সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:৪৫ পূর্বাহ্ন

এইচএসসি ফলাফলে ভয়াবহ বিপর্যয়: প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে ব্যর্থতা, ভেঙে পড়ছে জেলার শিক্ষা ভিত্তি

স্টাফ রিপোর্টার::
সুনামগঞ্জে ২০২৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল যেন এক করুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে জেলার শিক্ষা ব্যবস্থার। সিলেট শিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর সুনামগঞ্জ জেলার ১২ হাজার ৫৩৫ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৫ হাজার ৭৬৫ জন পাশ করেছে। পাশের হার ৪৭.৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ ফেল করেছে ৬ হাজার ৭৭০ জন শিক্ষার্থী – যা মোট পরীক্ষার্থীর ৫২.৬৫ শতাংশ।
এই বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, জেলার অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিকের বাধা পেরুতে পারেনি। অথচ গত বছর এই পাশের হার ছিল ৮৬.৯৪ শতাংশ – এক বছরের ব্যবধানে ৩৯.৫৯ শতাংশ কমে যাওয়া দেশের কোনো জেলায় নজিরবিহীন।
ফলাফলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক -জিপিএ-৫ প্রাপ্তির দিকেও দেখা গেছে বড় ধস। ২০২৪ সালে সুনামগঞ্জে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৪৩৬ জন, কিন্তু ২০২৫ সালে এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬০ জন। এক বছরে ৩৭৬ জন জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর পতন – যা ৮৬ শতাংশ হ্রাস।
সেরা প্রতিষ্ঠান: জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে সবচেয়ে এগিয়ে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ, যেখানে ৩২ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। পাশের হারে শীর্ষে দোয়ারাবাজার উপজেলার সমুজ আলী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ, যেখানে পাশের হার ৯৪.৬৪ শতাংশ। উপজেলার মধ্যে শাল্লা সবার আগে পাশের হারে।
সবচেয়ে খারাপ ফলাফল: দোয়ারাবাজারের প্রগতি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ-৭৩ জনের মধ্যে পাশ করেছে মাত্র ৪ জন (৫.৪৮%), দিরাইয়ের রজনীগঞ্জ হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ-৪৭ জনের মধ্যে পাশ ৩ জন (৬.৩৮%), ধর্মপাশার গোলকপুর হাজী এ. হাফেজ হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ-১৫ জনের মধ্যে পাশ ১ জন (৬.৬৭%) এছাড়াও জেলায় ২৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশের হার ৩০ শতাংশের নিচে, যেগুলোকে কার্যত ‘শূন্য’ ধরা হয়েছে।
বিশ্লেষণে উঠে এসেছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, যা এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা,  ইংরেজি বিষয়ে দুর্বলতা: প্রায় সব উপজেলাতেই শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইংরেজি পড়ানোর পদ্ধতির দৈন্যতা ও প্রাথমিক স্তরে সঠিক ভিত্তি না থাকাই এই দুর্বলতার মূল কারণ। বিজ্ঞান বিষয়ের ভীতি ও অনভ্যস্ততা: বিজ্ঞান বিভাগের ফলাফলও ছিল নাজুক। গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষার্থী ফেল করেছে। শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহ ও প্রযুক্তি আসক্তি: মোবাইল ফোন, বিশেষ করে ফেসবুক ও টিকটক ব্যবহারে আসক্তি, ক্লাসে অনুপস্থিতি এবং শিক্ষার প্রতি উদাসীনতা বড় প্রভাব ফেলেছে। অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব: অনেক পরিবারে শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব নেই। সন্তানদের শিক্ষা জীবন নিয়ে আগ্রহ, পরিবেশ তৈরি ও পর্যবেক্ষণের ঘাটতি স্পষ্ট। আগস্টের পর ক্লাসে অনুপস্থিতি: পরীক্ষার ঠিক আগমুহূর্তে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাসে না গিয়ে পড়ালেখা থেকে দূরে সরে যায়। এতে প্রস্তুতির ঘাটতি হয়।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মত: সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ইভা রায় জানান, “২০০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২০ জনও ক্লাসে আসে না।” তিনি আরও বলেন, “৩০ শতাংশের নিচে পাশ করা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ বলতে কিছু নেই।”
তিনি উল্লেখ করেন, ২২ অক্টোবর এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত ৩০২ জন নতুন শিক্ষক নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হবে, যেখানে জেলার শিক্ষা ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করা হবে।
প্রাইভেট কলেজ: টাকা নিচ্ছে, ফল দিচ্ছে না, অভিযোগ উঠেছে, জেলার বেশ কিছু প্রাইভেট কলেজ প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা নিলেও শিক্ষার মান নেই। অনেক প্রতিষ্ঠান মূলত ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে চলছে, যেখানে শিক্ষক নেই, ক্লাস নেই, সিলেবাস শেষ হয় না – অথচ ভর্তি, কোচিং ও ফরম ফিলাপে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হয়।
সুনামগঞ্জের এইচএসসি ফলাফলের এই ভয়াবহ চিত্র প্রমাণ করে দেয়, শিক্ষা ব্যবস্থায় এক মৌলিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। সমস্যা শুধুই ছাত্রছাত্রীর নয়-পরিবার, শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন-সবার সম্মিলিত ব্যর্থতা এর জন্য দায়ী। তাই এখনই সময়, শিক্ষা নিয়ে শোভন বক্তব্যের বাইরে এসে বাস্তবধর্মী, ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নেওয়ার। না হলে আগামীতে আরও ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2025 surmapostnewsbd.com
Design & Developed BY Ohhre Technologies Limited.